আবু মুহাম্মাদ তালহা তাঁর নাম। পিতা উবাইদুল্লাহ এবং মাতা সাবা। কুরাইশ গোত্রের তাইম শাখার সন্তান। হযরত আবু বকর (রা)ও ছিলেন এই তাইম কবীলার লোক। তাঁর মা সা'বা ছিলেন প্রখ্যাত শহীদ সাহাবী হযরত 'আলা ইবনুল হাদরামীর বোন ।
ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
হযরত তালহা ইসলামের সূচনা পর্বেই মাত্র পনেরো বছর বয়সে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা) দাওয়াতেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। জাহিলী যুগে আবু বকরের বাড়ীতে অনুষ্ঠিত বৈঠকের তিনি ছিলেন নিয়মিত সদস্য। তাঁর ইসলাম গ্রহণের ঘটনাটি বড় চমকপ্রদ। তিনি গেছেন কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলার সাথে সিরিয়া। তাঁরা যখন বসরা শহরে পৌঁছলেন, দলের অন্য কুরাইশ ব্যবসায়ীরা তাঁর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাজারের বিভিন্ন স্থানে কেনা-বেচায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
তিনি বাজারের মধ্যে ঘুরাফেরা করছেন, এমন সময় যে ঘটনাটি ঘটলো তা তালহার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। তিনি বলেনঃ
*আমি তখন বসরার বাজারে। একজন খৃস্টান পাদরীকে ঘোষণা করতে শুনলাম : ওহে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। আপনারা এ বাজারে আগত লোকদের জিজ্ঞেস করুন, তাদের মধ্যে মক্কাবাসী কোন লোক আছে কিনা। আমি নিকটেই ছিলাম। দ্রুত তার কাছে গিয়ে বললাম, 'হ্যাঁ, আমি মক্কার লোক।' জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমাদের মধ্যে আহমাদ কি আত্মপ্রকাশ করেছেন?' বললাম 'কোন আহমাদ?' বললেন, 'আবদুল্লাহ ইবন আবদিল মুত্তালিবের পুত্র। যে মাসে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন, এটা সেই মাস। তিনি হবেন শেষ নবী। মক্কায় আত্মপ্রকাশ করে কালো পাথর ও খেজুর উদ্যান বিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরাত করবেন। যুবক, খুব তাড়াতাড়ি তোমার তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।' তালহা বলেন, 'তাঁর এ কথা আমার অন্তরে দারুণ প্রভাব সৃষ্টি করলো। আমি আমার কাফিলা ফেলে রেখে বাহনে সওয়ার হলাম । বাড়ীতে পৌঁছেই পরিবারের লোকদের কাছে জিজ্ঞেস করলাম : আমার যাওয়ার পর মক্কায় নতুন কিছু ঘটেছে কি? তারা বললো : হাঁ, মুহাম্মাদ ইবন আবদিল্লাহ নিজেকে নবী বলে দাবী করেছে এবং আবু কুহাফার ছেলে আবু বকর তাঁর অনুসারী হয়েছে।'
তালহা বলেন, আমি আবু বকরের কাছে গেলাম এবং তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম : এ কথাকি সত্যি যে, মুহাম্মাদ নবুওয়াত দাবী করেছেন এবং আপনি তাঁর অনুসারী হয়েছেন? বললেন ঃ হাঁ, তারপর তিনি আমাকেও ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আমি তখন খৃস্টান পাদরীর ঘটনা তাঁর কাছে খুলে বললাম । অতঃপর তিনি আমাকে সংগে করে রাসূলুল্লাহরﷺনিকট নিয়ে গেলেন। আমি সেখানে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করলাম এবং রাসূলুল্লাহরﷺনিকট পাদরীর কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলাম। শুনে তিনি দারুণ খুশী হলেন। এভাবে আমি হলাম আবু বকরের হাতে ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ ব্যক্তি ।
ইসলামের পথে ত্যাগ
তালহার ইসলাম গ্রহণে তাঁর মা বড় বেশী হৈ চৈ শুরু করলেন। কারণ, তাঁর বাসনা ছিল, ছেলে হবে গোত্রের নেতা। গোত্রীয় লোকেরা তাঁকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য চাপাচাপি করে দেখলো তিনি পাহাড়ের মত অটল। সোজা আংগুলে ঘি উঠবে না ভেবে তারা নির্যাতনের পথ বেছে নিল। মাসুদ ইবন খারাশ বলেন : 'একদিন আমি সাফা-মারওয়ার মাঝখানে দৌড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম, একদল লোক হাত বাঁধা একটি যুবককে ধরে টেনে নিয়ে আসছে। তারপর তাকে উপুড় করে শুইয়ে তার পিঠে ও মাথায় বেদম মার শুরু করলো। তাদের পেছনে একজন বৃদ্ধ মহিলা চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে তাকে গালাগালি দিচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম : ছেলেটির এ অবস্থা কেন? তারা বললো ঃ এ হচ্ছে তালহা ইবন উবাইদুল্লাহ। পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করে বনী হাশিমের সেই লোকটির অনুসারী হয়েছে। এ মহিলাটি কে? তারা বললো : সা'বা বিনতু আল-হাদরামী যুবকটির মা
কুরাইশদের সিংহ বলে পরিচিত নাওফিল ইবন খুয়াইলিদ তালহার কাছে এলো। তাঁকে একটি রশি দিয়ে বাঁধলো এবং সেই একই রশি দিয়ে বাঁধলো আৰু বকরকেও। তারপর তাদের দু'জনকে সোপর্দ করলো মক্কার গোঁয়ার লোকদের হাতে নির্যাতন চালানোর জন্য। একই রশিতে তাঁদের দু'জনকে বাঁধা হয়েছে, তাই তাঁদেরকে বলা হয় 'কারীনান'।
ইসলাম গ্রহণের পর এভাবে তিনি আপনজন ও কুরাইশদের যুলুম অত্যাচারের শিকার হন। দীর্ঘ তেরো বছর অসীম ধৈর্যের সাথে সবকিছু সহ্য করেন এবং একনিষ্ঠভাবে ইসলামের তাবলীগ ও প্রচারের কাজ চালিয়ে যান। তিনি মক্কার আশ পাশের উপত্যকায় বিদেশী অভ্যাগতদের সন্ধান করতেন, বেদুঈনদের তাঁবু এবং শহরের পরিচিত অংশীবাদীদের গৃহে চুপিসারে উপস্থিত হয়ে তাদের নিকট দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতেন । মক্কার 'দারুল আরকামে' অন্যদের মত তিনিও নিয়মিত যেতেন। ইসলাম ও মুসলমানদের এ দুঃসময়ে আল্লাহর দ্বীনের জন্য তিনি সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা ও সাধনা করেছেন ।
মক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত
৬২২ সনের অক্টোবর মাসে আবু বকরকে সংগে করে রাসূলﷺমক্কা থেকে মদীনায় হিজরাত করেন। তাঁদের এ দুর্গম সফরের পথ প্রদর্শক ছিলেন আবদুল্লাহ ইবন উরায়কাত। তিনি তাঁদেরকে মদীনায় পৌঁছে দিয়ে মক্কায় ফিরে আসেন এবং আবু বকরের পুত্র আবদুল্লাহর নিকট তাঁদের সফরের কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করেন। হযরত আবু বকরের পরিবার-পরিজন মদীনায় হিজরাতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন সময় হযরত তালহা ও সুহায়েব ইবন সিনান তাঁদের সাথে যোগ দেন। তালহা হলেন সেই কাফিলার আমীর। মদীনায় উপস্থিত হয়ে তালহা ও সুহায়েব হযরত আসয়াদ ইবন যারারার বাড়ীতে অবস্থান করতে থাকেন। ইবন হাজার বলেন : হিজরাতের পূর্বে মক্কায় তালহা ও যুবাইরের মধ্যে রাসূলﷺভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম করে দিয়েছিলেন এবং হিজরাতের পর মদীনার প্রখ্যাত আনসারী সাহাবী আৰু আইউব আনসারীর সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপিত হয়। অবশ্য অন্য একটি বর্ণনায় জানা যায়, রাসূলﷺকা'ব বিন মালিকের সাথে তাঁর ভ্রাতৃ-সম্পর্ক স্থাপন করে দিয়েছিলেন এবং আপন ভায়ের মত আমরণ তাঁদের এ সম্পর্ক অটুট ছিল।
আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ
বদর যুদ্ধে তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ না করলেও পরোক্ষভাবে করেছিলেন। এ কারণে রাসূলুল্লাহﷺতাঁকে গণীমতের হিস্সা দিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় একদল কাফির মদীনার মুসলিম জনপদের ওপর আক্রমণের ষড়যন্ত্র করেছিল। রাসূলﷺতাদের খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য তালহাকে পাঠিয়েছিলেন। তালহা ছাড়াও সাত ব্যক্তিকে রাসুলﷺবিভিন্ন দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পাঠিয়েছিলেন। এ কারণে প্রত্যক্ষভাবে তাঁরা যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। তবে তাঁদেরকে বদরী হিসাবে গণ্য করা হয়।
হিজরী তৃতীয় সনে মক্কার মুশরিকদের সাথে সংঘটিত হয় উহুদের যুদ্ধ। এ যুদ্ধে হযরত তালহা বীরত্ব ও সাহসিকতার নজীরবিহনী রেকর্ড স্থাপন করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ছিলেন উহুদ যুদ্ধের হিরো। তীরন্দাজ বাহিনীর ভুলের কারণে মুসলিম বাহিনী যখন দারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন, তখন যে ক'জন মুষ্টিমেয় সৈনিক আল্লাহর রাসূলকে ঘিরে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেন, তালহা তাদের অন্যতম । এ সময় হযরত আম্মার বিন ইয়াযিদ শহীদ হন। কাতাদা বিন নু’মানের চোখে কাফিরের নিক্ষিপ্ত তীর লাগলে চক্ষু কোটর থেকে মণিটি বের হয়ে তাঁর গণ্ডের ওপর ঝুলতে থাকে। আবু দুজানা রাসূলুল্লাহরﷺদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে তাঁর পুরো দেহটি ঢাল বানিয়ে নেন। এ সময় সাদ বিন আবী ওয়াক্কাস অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তীর ছুড়ছিলেন। আর তালহা এক হাতে তলোয়ার ও অন্যহাতে বর্শা নিয়ে কাফিরদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান
যুদ্ধের এক পর্যায়ে আনসারদের বারোজন এবং মুহাজিরদের এক তালহা ছাড়া আর সকলে রাসূলুল্লাহরﷺনিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। রাসূলﷺপাহাড়ের একটি চূড়ায় উঠলেন, এমন সময় একদল শত্রুসৈন্য তাঁকে ঘিরে ফেললো। রাসূলﷺতাঁর সংগের লোকদের বললেন : 'যে এদের হটিয়ে দিতে পারবে, জান্নাতে সে হবে আমার সাথী।' তালহা বললেন : আমি যাব ইয়া রাসূলাল্লাহ। রাসূলﷺবললেন : না, তুমি থাম। একজন আনসারী বললো : আমি যাব। বললেন : হাঁ, যাও। আনসারী গেলেন এবং মুশরিকদের সাথে যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। এভাবে বার বার রাসূলﷺআহ্বান জানালেন এবং প্রত্যেক বারই, তালহা যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, কিন্তু রাসূল (সা.) তাঁকে নিবৃত্ত করে একজন আনসারীকে পাঠালেন। এভাবে এক এক করে যখন আনসারীদের সকলে শাহাদাৎ বরণ করলেন, তখন রাসূলﷺতালহাকে বললেন : এবার তোমার পালা, যাও ।
হযরত তালহা আক্রমণ চালালেন। রাসূলﷺআহত হলেন, তাঁর দান্দান মুবারক শহীদ হলো এবং তিনি রক্ত রঞ্জিত হয়ে পড়লেন। এ অবস্থায় তালহা একাকী একবার মুশরিকদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদেরকে একটু দূরে তাড়িয়ে দেন, আবার রাসূলেরﷺদিকে ছুটে এসে তাকে কাঁধে করে পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে থাকেন এবং এক স্থানে রাসূলকে (রা) রেখে আবার নতুন করে হামলা চালান। এভাবে সেদিন তিনি মুশরিকদের প্রতিহত করেন। হযরত আবু বকর বলেন : এ সময় আমি ও আবু উবাইদা রাসূলﷺথেকে দূরে সরে পড়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা রাসূলেরﷺনিকট ফিরে এসে তাঁকে সেবার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বললেন : 'আমাকে ছাড়, তোমাদের বন্ধু তালহাকে দেখো'। আমরা তাকিয়ে দেখি, তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় একটি গর্তে অজ্ঞান হয়ে আছেন। তাঁর একটি হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন প্রায় এবং সারা দেহে তরবারী ও তীর বর্শার সত্তরটির বেশী আঘাত। তাই পরবর্তীকালে রাসূলﷺতাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ঃ যদি কেউ কোন মৃত ব্যক্তিকে পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে দেখে আনন্দ পেতে চায়, সে যেন তালহা ইবন উবাইদুল্লাহকে দেখে। এ কারণে তাঁকে জীবিত শহীদ বলা হতো। হযরত সিদ্দীকে আকবর (রা) উহুদ যুদ্ধের প্রসংগ উঠলেই বলতেন : 'সে দিনটির সবটুকুই তালহার।' এ যুদ্ধে হযরত তালহার কাজে আল্লাহর রাসূলﷺএত প্রীত হন যে তিনি তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউসের সুসংবাদ দান করেন।
পঞ্চম হিজরী সনের যিলকাদ মাসে আরবের বিভিন্ন গোত্র ও ইহুদীদের সম্মিলিত বাহিনী মদীনা আক্রমণের তোড়জোড় শুরু করে। এদিকে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য রাসূলুল্লাহরﷺনেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী মদীনার উপকণ্ঠে সালা পর্বতের পাশ দিয়ে পূর্ব পশ্চিমে পাঁচ হাত গভীর খন্দক খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ খন্দক খননের কাজে হযরত তালহাকেও ব্যস্ত দেখা যায়। খন্দক খননের কাজ শেষ হতে না হতেই মক্কার কুরাইশ ও অন্যান্য আরব গোত্রের সম্মিলিত বাহিনী মদীনা অবরোধ করে। এদিকে মদীনার অভ্যন্তরে ইহুদী গোত্রগুলি, বিশেষতঃ বনু কুরাইজা চুক্তি ভংগ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এ সময় মুসলমানরা ভিতর ও বাইরের শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু সংখ্যক মুসলমান স্ত্রী-পুত্র পরিজনের নিরাপত্তার চিন্তায় স্বাভাবিকভাবেই একটু অস্থির হয়ে পড়েন। কিন্তু অধিকাংশ মুসলমানের মনোবল এবং আল্লাহর প্রতি তাঁদের ঈমান অটল থাকে। তাঁরা নিজেদের জান-মাল সবকিছু আল্লাহর পথে কুরবানী করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিলেন। হযরত তালহা ছিলেন শেষোক্ত দলের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা সূরা আহযাবের দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুকুতে মুসলমানদের এ সময়কার মানসিক চিত্র সুন্দরভাবে অংকন করেছেন।
খন্দকের ধারে দাঁড়িয়ে কতিপয় মুসলমান আলাপ-আলোচনা করছে। হযরত তালহা যাচ্ছেন পাশ দিয়ে। তাঁর কানে ভেসে এলো, একজন বলছে : আমাদের স্ত্রী পরিজনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা উচিত। হযরত তালহা একটু থমকে দাঁড়ালেন। বললেন : “আল্লাহু খায়রুন হাফিজান আল্লাহ সর্বোত্তম নিরাপত্তা বিধানকারী। যারা নিজেদের - শক্তি ও বাহুবলের ওপর ভরসা করেছে, ব্যর্থ হয়েছে। লোকেরা বললো : আপনি ঠিকই বলেছেন। তারা তাদের উদ্দেশ্য থেকে বিরত থাকলো ।
বাইয়াতে রিদওয়ান, খাইবার ও মুতাসহ সব অভিযানেই তিনি অংশগ্রহণ করে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। মক্কা বিজয়ের দিন মুহাজিরদের যে ক্ষুদ্র দলটির সাথে রাসূলﷺমক্কায় প্রবেশ করেন, তালহা ছিলেন সেই দলে এবং রাসূলুল্লাহরﷺসাথেই তিনি পবিত্র কা'বার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন।
হজ্জের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে যাত্রা
দশম হিজরী সনের ২৫শে যুলকা'দা রাসূলﷺহজ্জের উদ্দেশ্যে মদীনা থেকে যাত্রা শুরু করেন। এটাই ছিল ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জ। রাসূলুল্লাহরﷺসফর সংগী হন তালহাও। তিনি রাসূলুল্লাহরﷺসাথে যুলহুলায়ফা পৌঁছে ইহরাম বাঁধেন। এ সফরে একমাত্র রাসূলﷺও তালহা ছাড়া আর কারও সংগে কুরবানীর পশু ছিলনা। (সহীহুল বুখারী কিতাবুল হজ্জ)।
প্রিয় নবীর ইন্তিকালে হযরত তালহা দারুণ আঘাত পান। রাসূলুল্লাহরﷺশোকে তিনি কাতর হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে বলতেন : আল্লাহ তায়ালা সকল মুসীবতে ধৈর্য ধরার হুকুম দিয়েছেন, তাই তাঁর বিচ্ছেদে 'সবরে জামীল' অবলম্বনের চেষ্টা করি এবং সংগে সংগে আল্লাহর কাছে তাওফীকও কামনা করি।'
হযরত আবু বকরের খিলাফতকালে তিনি তাঁর বিশেষ উপদেষ্টা ছিলেন। চিন্তা, পরামর্শ ও কাজের মাধ্যমে সব ব্যাপারে তিনি তাঁকে সাহায্য করেন। রিদ্দার যুদ্ধের সময় অনেক বিশিষ্ট সাহাবী যাকাত আদায় করতে অস্বীকারকারী বেদুইনদের সাথে কিছুটা কোমল আচরণ করার জন্য এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা না করার জন্য প্রথমতঃ খলীফাকে পরামর্শ দেন। কিন্তু হযরত তালহা স্পষ্ট করে বলে দেন : 'যে দ্বীনে যাকাত থাকবে না তা সত্য ও সঠিক হতে পারে না।
হিজরী ১৩ সনের জামাদিউস সানী মাসে হযরত আবু বকর (রা) অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁর অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে লাগলো। একদিন হযরত তালহা তাঁকে গেলেন দেখতে। তিনি উপস্থিত হলে কিছুক্ষণ নিরবতার পর উভয়ের মধ্যে নিম্নোক্ত কথা হয় :
- উমারকে কি স্থলাভিষিক্ত করবো? আবু মুহাম্মাদ (তালহা), আপনার মত কি? সাহাবীদের মধ্যে উমার সর্বোত্তম গুণের অধিকারী, তিনি সত্য ও মিথ্যার পার্থক্যকারী।
- তাঁকে আমার স্থলাভিষিক্ত করার ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ চেয়েছি।
- তাঁর স্বভাবে কিছুটা কঠোরতা আছে এবং তিনি একটু বেশী কড়াকড়ি আরোপ করে থাকেন।
- তাঁর মধ্যে কি কি ত্রুটি আছে?
- আপনার সময়ে তিনি যখন এত কঠোর, আপনার পরে স্বীয় দায়িত্বানুভূতিতে না
-জানি কত বেশী কঠোর হয়ে পড়েন।
- তাঁর ওপর যখন খিলাফতের গুরু দায়িত্ব এসে পড়বে, তিনি নরম হয়ে যাবেন। সবশেষে তালহা বললেন : তাঁর গুণাবলী ও যোগ্যতা যে সকলের থেকে বেশী, সে ব্যাপারে আমার দ্বিমত নেই। তাঁর স্বভাবের একটি দিক সম্পর্কে আমার যা প্রতিক্রিয়া তা
ব্যক্ত করতে আমি কার্পণ্য করিনি।
হিজরী ১৩ সনে হযরত উমার খলীফা হলেন। তিনিও হযরত তালহাকে যথোপযুক্ত মর্যাদা দিলেন এবং সর্বদা তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করে উপকৃত হলেন ।
ইরাক বিজয়ের পর সেখানকার কৃষি জমি গণীমতের মালের মত মুজাহিদদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করা হবে কি হবে না, এ প্রশ্নে সাহাবীদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিল । একদল বললেন, ভাগ করাই উচিত হবে। কিন্তু খলীফা সহ অন্য একটি দল ছিলেন ভাগের বিরোধী। অতঃপর মজলিসে শূরার বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনার পর খলীফার মতই সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এ ব্যাপারে হযরত তালহা শূরার বৈঠকে দ্ব্যর্থহীনভাবে খলীফার মতকে সমর্থন করে জোরালো বক্তব্য রাখেন।
আমীরুল মু'মিনীন হযরত উমারের (রা) ওফাতের পূর্বে যে ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর ওপর তাঁদের মধ্য থেকে যে কোন একজনকে খলীফা নির্বাচনের দায়িত্ব দিয়ে যান, তার মধ্যে হযরত তালহাও ছিলেন। কিন্তু তিনি আত্মত্যাগের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নিজে খিলাফাতের দাবী থেকে সরে দাঁড়ান এবং হযরত উসমানের সমর্থনে নিজের ভোটটি প্রদান করেন।
হযরত উসমান (রা) বিদ্রোহীদের দ্বারা গৃহবন্দী হলেন। একদিন তিনি ঘরের জানালা দিয়ে মাথা বের করে বিদ্রোহী গ্রুপ ও মদীনার সমবেত লোকদের উদ্দেশ্য করে বক্তব্য রাখলেন। এক পর্যায়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন : তোমাদের মধ্যে কি তালহা আছেন? কেউ কোন উত্তর দিল না । এভাবে যখন তিনি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, তখন হযরত তালহা উঠে দাঁড়ালেন। হযরত উসমান তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন : এ জনতার মধ্যে আপনার উপস্থিতি এবং তিনবার জিজ্ঞেস করার পর সাড়া দেবেন, এমন আশা আমি করিনি। আমি আপনাকে আল্লাহর নামে জিজ্ঞেস করছি, একদিন অমুক স্থানে, যখন রাসূলুল্লাহরﷺসংগে আমি ও আপনি ছাড়া আর কেউ ছিল না, রাসূলﷺআপনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন : তালহা, প্রত্যেক নবীরই তাঁর উম্মতের মধ্য থেকে জান্নাতে একজন সংগী থাকবে। উসমান ইবন আফফানই হবে জান্নাতে আমার সংগী। সে কথা আপনার স্মরণ আছে? তালহা সায় দিলেন, হাঁ। তারপর তিনি জনতার ভেতর থেকে উঠে চলে গেলেন।
ইনতিকাল
হযরত উসমান শহীদ হলেন। মুসলিম উম্মাহর একটি অংশ হযরত উসমানের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে কিসাস দাবী করলেন। হযরত তালহা ও যুবাইর মদীনা থেকে মক্কায় গিয়ে হযরত আয়িশার (রা) সাথে মিলিত হলেন। উসমানের হত্যাকারীদের নির্মূল করার উদ্দেশ্যে মক্কা থেকে তারা বসরায় উপনীত হলেন। বসরার উপকণ্ঠেই তারা হযরত আলীর (রা) সেনাবাহিনীর মুখোমুখী হলেন। হযরত কা'কা ইবন *আমরের মাধ্যমে উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। হযরত আলী, উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়িশা, তালহা ও যুবাইর সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছলেন। উভয় পক্ষ তৃপ্তির নিশ্বাস ফেললো। কিন্তু চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রকারী ইহুদী ইবন সাবার লোকেরা এতে প্রমাদ গুণলো। মূলতঃ তারাই ছিল হযরত উসমানের হত্যাকারী। তারা হযরত আলীর সেনাবাহিনীর মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে ছিল। রাতের অন্ধকারে তারা একদিকে হযরত আয়িশার এবং অন্য দিকে হযরত আলীর সেনাবাহিনীর ওপর তীর নিক্ষেপ শুরু করলো। উভয় পক্ষের সৈন্যরা শান্তিচুক্তির সিদ্ধান্ত হওয়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল। অতর্কিত এ আক্রমণে ঘুম থেকে জেগে তারা মনে করলো প্রতিপক্ষ আক্রমণ শুরু করেছে। ইহুদী ইবন সাবার চক্রান্ত সফল হলো। সকাল হতে না হতে তুমুল লড়াই বেঁধে গেল এবং ইতিহাসে এ লড়াই ‘উটের যুদ্ধ' নামে খ্যাত হলো । এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের প্রায় দশ মতান্তরে তের হাজার লোক নিহত হলেন। এ যুদ্ধের সূচনা লগ্নেই সাবায়ীদের নিক্ষিপ্ত একটি তীর হযরত তালহার পায়ে বিধে। ক্ষত স্থান থেকে রক্ত পড়া বন্ধ হচ্ছে না দেখে হযরত কা'কা ইবন আমর তাঁকে অনুরোধ করলেন বসরার 'দারুল ইলাজে' (হাসপাতাল) চলে যাওয়ার জন্য। তাঁরই অনুরোধে তিনি একটি
চাকরকে সংগে করে 'দারুল ইলাজে' চলে যান। কিন্তু ইত্যবসরে তাঁর দেহ রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। সেখানে পৌঁছার কিছুক্ষণ পরেই তিনি ইনতিকাল করেন। বসরাতেই তাঁকে দাফন করা হয়।
ইবন আসাকির বিভিন্ন সূত্রে উল্লেখ করেছেন যে, উটের যুদ্ধের দিন মারওয়ান ইবনুল হিকামের নিক্ষিপ্ত তীরে হযরত তালহা আহত হন। হিজরী ৩৬ সনের জামাদিউল আউয়াল মতান্তরে ১০ই জামাদিউস সানী ৬৪ বছর বয়সে তিনি ইনতিকাল করেন।
হযরত তালহা ছিলেন একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী। কিন্তু সম্পদ পুঞ্জিভূত করার লালসা তাঁর ছিলনা। তাঁর দানশীলতার বহু কাহিনী ইতিহাসে পাওয়া যায়। ইতিহাসে তাঁকে 'দানশীল তালহা' বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একবার হাদরামাউত থেকে সত্তর হাজার দিরহাম তাঁর হাতে এলো। রাতে তিনি বিমর্ষ ও উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। তাঁর স্ত্রী হযরত আবু বকরের (রা) কন্যা উম্মু কুলসুম স্বামীর এ অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করলেন : আবু মুহাম্মদ, আপনার কী হয়েছে? মনে হয় আমার কোন আচরণে আপনি কন্ঠ পেয়েছেন।
- না, একজন মুসলমান পুরুষের স্ত্রী হিসেবে তুমি বড় চমৎকার। কিন্তু সেই সন্ধ্যা থেকে আমি চিন্তা করছি, এত অর্থ ঘরে রেখে ঘুমালে একজন মানুষের তার পরওয়ারদিগারের প্রতি কিরূপ ধারণা হবে? - এতে আপনার বিষণ্ন ও চিন্তিত হওয়ার কি আছে? এত রাতে গরীব-দুঃখী ও
আপনার আত্মীয় পরিজনদের কোথায় পাবেন? সকাল হলেই বন্টন করে দেবেন।
- আল্লাহ তোমার ওপর রহম করুন! একেই বলে, বাপ কি বেটী। পরদিন সকাল বেলা ভিন্ন ভিন্ন থলি ও পাত্রে সকল দিরহাম ভাগ করে মুহাজির ও আনসারদের গরীব মিসকীনদের মধ্যে তিনি বন্টন করে দেন। তাঁর দানশীলতা সম্পর্কে অপর একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। এক ব্যক্তি হযরত তালহার নিকট এসে তাঁর সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে কিছু সাহায্য চাইলো। তালহা বললেন : অমুক স্থানে আমার একখণ্ড জমি আছে। উসমান ইবন আফফান উক্ত জমির বিনিময়ে আমাকে তিন লাখ দিরহাম দিতে চান। তুমি ইচ্ছে করলে সেই জমিটুকু নিতে পার বা আমি তা বিক্রি করে তিন লাখ দিরহাম তোমাকে দিতে পারি। লোকটি মূল্যই নিতে চাইলো । তিনি তাঁকে বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ দান করেন।